ঊনিশ শ’ সাতচল্লিশ সালের ১৪ আগস্টে কিছু ধর্মোন্মাদ রাজনৈতিক নেতা আর ইংরেজ শাসকদের কলমের খোঁচায় সহশ্র বছরের অবিভক্ত ভারত, পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে দেখা দিলেও এই অসম বিভক্তির কারণে দুই দেশের কোটি কোটি মানুষ এমন এক ভয়াবহ জটিলতার মধ্যে পড়ে যায়, যার ওপর তাদের নিজেদের কারো কোন হাত ছিল না।
সে সময়ের রাজনৈতিক নেতাদের স্বেচ্ছাচারিতা, ধর্মোন্মত্ততা, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, হিংসা আর ক্ষমতার লোভের কারণে লক্ষ কোটি নিরীহ জনগোষ্ঠি ১৫ আগস্ট ভোর হতে না হতেই শরণার্থীর খাতায় নাম লেখাতে বাধ্য হলো। নিশ্চিন্তে পাশাপাশি বসবাসকারী দুটি ধর্মীয় সমপ্রদায় দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে হঠাৎ করে পরস্পর চিরশত্রুতে পরিণত হয়ে গেল। তারই ধারাবাহিকতা আজও দক্ষিণ এশিয়ায় একটা দগদগে বিষাক্ত ক্ষত, তিনটি দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠিকে বিষাক্ত করে চলেছে। যে ক্ষতের উপশম করতে এই তিনটি রাষ্ট্রের কোন রাষ্ট্রনায়কই সচেষ্ট হননি; হচ্ছেন না; বরং সেই ক্ষতকে খুঁচিয়ে খুচিয়ে আরও দগদগে করে তুলছেন প্রতি মুহূর্তে।
ইতিহাসের পাতায় দেখা যাবে, মুহম্মদ বিন কাশিমের সময় থেকে ঊনিশ শতক পর্যন্ত অবিভক্ত ভারতে বৌদ্ধ ও হিন্দুদের মধ্যে, হিন্দু ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে এবং হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সামপ্রদায়িক দাঙ্গা যে দেখা দেয়নি তা নয়। ছোটখাট ধর্মীয় সংঘর্ষের অনেক ঘটনার বিবরণ পাওয়া যাবে এ দীর্ঘ সময়ে। তা’ছাড়া প্রতিটি ধর্মের মধ্যে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য গোত্র ও গোষ্ঠির মধ্যে সংঘর্ষও কিন্তু কম হয়নি। বরং আমার মনে হয়, আন্তঃধর্ম সংঘর্ষের চেয়ে গোত্রভ্যন্তরের সংঘাতের সংখ্যা ও সে সবের উত্তাপে দগ্ধ নিরীহ মানবসন্তানের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়!
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ইংরেজ শাসক যখন হিন্দু আর মুসলমান সম্মিলিত শক্তির আগুনের আঁচ টের পেলো, তখন থেকেই ব্রিটিশ শাসকবর্গ নানা কূট কৌশল অবলম্বন করে ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ অর্থাৎ বিভক্তির মাধ্যমে শাসন পদ্ধতির মাধ্যমে এ দেশটিকে শোষণ করতে সচেষ্ট থাকে। দুই বিশাল ধর্মের অসংখ্য অনুসারীদের একের সাথে অন্যের বিরোধ সৃষ্টিতে তারা প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে। যার ভয়াবহতায় চল্লিশ দশক থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় সামপ্রদায়িক সংঘর্ষ আরম্ভ হয়ে যায়।
১৯০৫ সালে পূর্ব বাংলা ও আসামকে নিয়ে পৃথক প্রদেশ করে এই অঞ্চলের উন্নয়ন করতে চেয়েছিলেন ব্রিটিশরা। বেঙ্গলের বিশাল শিক্ষিত জনগোষ্ঠি, রবীন্দ্রনাথ সহ সবাই এর তীব্র বিরোধিতা করে ব্রিটিশদের উন্নয়ন প্রয়াস নস্যাত করে দিলেন। রবীন্দ্রনাথ অখণ্ড বাংলার পক্ষে বেশ কয়টা গান লিখলেন। তার মধ্যে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ অন্যতম।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রবক্তারা এই গান গেয়ে তাদের প্রতিবাদ জানাতেন। অথচ ১৯৪৭ সালে তারাই মহা উৎসাহে ঢাক ঢোল পিটিয়ে সেই ‘প্রাণের বাংলা’কেই ভাগ করে দিলেন।
মজার ব্যাপার, ‘অখন্ড বাংলার পক্ষের গান’ হয়ে উঠলো খণ্ডিত স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত।
সাতচল্লিশ সালে দেশবিভাগের কথা উচ্চারণের সাথে সাথে প্রাণের ভয়ে ভারতে অবস্থিত অসংখ্য মুসলমান যেমন মুসলমান অধ্যুষিত পাকিস্তানে চলে যেতে উন্মাদ হয়ে উঠলো। একইভাবে পাকিস্তানের বিপুল সংখ্যক অমুসলিম নাগরিক ভারতে চলে যেতে মরিয়া হয়ে উঠলো।
দুই দেশের এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠিকে নির্বিঘ্নে স্ব স্ব পছন্দের দেশে চলে যাওয়া আর বসতি ও ব্যবসায়-বাণিজ্য স্থাপনের সুবিধা করে দেওয়ার জন্যে উভয় দেশের সরকারই তাদের দুই দিকের সীমান্ত বেশ কিছুকাল অবারিত করে রাখতে বাধ্য হয়েছিল।
তিপ্পান্ন সালের দিকে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে পাসপোর্ট-ভিসা ব্যবস্থা চালু হয়। পাসপোর্ট-ভিসা চালুর আগে দুই দেশের নাগরিক যে কয়বার আর সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সারাদিনের মধ্যে যখন খুশি সীমান্ত পার হয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাতায়াত করতে পারতো, নিয়ে যেতে পারতো তাদের অর্থ-সম্পদ। কোন বাঁধা ছিল না।
অবশ্য সে সময় নিরীহ ও বোকা কিসিমের মানুষ যাতায়াতের পথে নানা ধরনের প্রতারণা ও ছিনতাইয়ের শিকার যে হতো না তার বলার অপেক্ষা করে না। কেউ হারাতো তার সারা জীবনের সঞ্চয়- অর্থ, সোনা-দানা, এমন কি পরিবারের কিশোরী বা অল্পবয়সী নারীরা প্রতারণার খপ্পরে পড়ে একেবারে লাপাত্তা হয়ে যেত।
লেখক: লেখক, অনুবাদক, সংকলক, প্রাবন্ধিক, গবেষক, ডাকটিকিট ও মুদ্রা সংগ্রাহক। খণ্ডকালীন শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।